‘শস্যভান্ডার’ হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিল একটি ঐতিহাসিক ও পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাশয়, যা চট্টগ্রামের শস্য ভান্ডারের অন্যতম পরিচয় বহন করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য এবং কৃষির জন্য এটি এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে, আধুনিককালের বিভিন্ন মানবসৃষ্ট সমস্যায় এই বিল আজ হুমকির মুখে। জমি ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, মাছ শিকার ও বর্জ্য ফেলা ইত্যাদি পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গুমাই বিলের ইতিহাস অনেক পুরনো। এটি একটি প্রাকৃতিক জলাশয় যা মূলত বর্ষা মৌসুমে ভরে ওঠে। বহু বছর ধরে এখানে কৃষকরা জলজ শস্যের চাষ করেন এবং পুকুরে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই বিলটি একটি বিশেষ কৃষি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। চট্টগ্রামের এই বিলের পানি স্থানীয় কৃষকদের জন্য সেচের কাজেও ব্যবহার হত।
গুমাই বিলের জলাধারটি সাধারণত বছরের বেশিরভাগ সময়ই শুকিয়ে যায়, তবে বর্ষাকালে এটি ভরে ওঠে। বিশেষ করে এই সময়টি বিভিন্ন প্রজাতির মাছের জন্য প্রজননকাল হয়ে থাকে। এ কারণে এটি স্থানীয় বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গুমাই বিল কেবলমাত্র কৃষি বা পরিবেশগত দিক দিয়ে নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রতি বছর নানা ধরনের মেলা এবং উৎসব আয়োজন করা হয়, যা স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। গুমাই বিলের পাশ দিয়ে চলে আসা বহু পাকা সড়ক ও সেতু স্থানীয়দের কাছে গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, স্থানীয়দের মধ্যে মাছ ধরা, নৌকা চালানো এবং জলবায়ু সম্পর্কিত সংস্কৃতিও বেশ সমৃদ্ধ।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুল বলেন, ‘গুমাই বিল রাঙ্গুনিয়ার জন্য ঐতিহ্যপূর্ণ একটি অংশ এবং এটি শুধু কৃষির জন্যই নয়, পরিবেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিলকে রক্ষা করতে প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’
এই বিলের পানি সাধারণত শীতকালে শান্ত থাকে, যা প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিক থেকে অত্যন্ত মনোরম। এ সময়ে এখানে বিভিন্ন পাখির বসবাসও লক্ষ্য করা যায়, যা গুমাই বিলের জীববৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করে।
যদিও গুমাই বিল একসময় স্থানীয়দের জন্য একটি প্রাকৃতিক রিসোর্স ছিল, বর্তমানে এটি পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে। জমি ভরাট করে অবৈধ দালান নির্মাণ, মাছ শিকার ও বর্জ্য ফেলা কিছু অতি উৎসাহী মানুষের কারণে এই বিলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপন্ন হচ্ছে। বিশেষ করে জলাশয়ের আশেপাশে অবৈধ বসতি গড়ে উঠছে এবং ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়া, গুমাই বিলের পানির স্তর ক্রমেই কমে যাচ্ছে, যা জলজ উদ্ভিদের জন্য একটি বিপদের সংকেত। এসব কারণে গুমাই বিলের ঐতিহ্য এবং বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গুমাই বিল রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় প্রশাসন এই বিলের অবৈধ দখলদারিত্ব রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘গুমাই বিলকে রক্ষা করতে হলে জমি ভরাট এবং অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’
এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব ঝুঁকি রয়েছে, তা মোকাবেলা করার জন্য স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং গুমাই বিলের পরিবেশ রক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিলের পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য আরও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গুমাই বিলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে হলে স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত দিক থেকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার, প্রশাসন এবং স্থানীয় জনগণের যৌথ উদ্যোগেই এই ঐতিহ্যবাহী জলাশয়টি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।
গুমাই বিল যদি বর্তমান পরিবেশগত বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে পারে, তবে এটি একসময় চট্টগ্রামের অন্যতম আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক ও কৃষিকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হতে থাকবে।