প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ

দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কারে গঠিত পরামর্শক কমিটি। একই সঙ্গে ‘সহকারী শিক্ষক’ পদ বিলুপ্ত করে প্রবেশন পর্যায়ে ‘শিক্ষক’ পদে দ্বাদশ গ্রেডে বেতন দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের বেতন দশম গ্রেডে দেওয়া এবং পদোন্নতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব সুপারিশ তুলে ধরেন কমিটির আহ্বায়ক মনজুর আহমেদ।

বর্তমানে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ত্রয়োদশ গ্রেডে ও প্রধান শিক্ষকরা একাদশ গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। এদিন বিকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

সংবাদ সম্মেলনে মনজুর আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের শিক্ষাকর্মীদের পেশাগত মর্যাদা, পদোন্নতি ও পেশাগত অগ্রগতির ব্যাপারে নির্দিষ্ট ও দ্রুত পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাব অনুসারে ‘সহকারী শিক্ষক’ পদবি বিলুপ্ত হবে, ‘শিক্ষক’ হিসেবে কর্মজীবনের সূচনার পর ‘সিনিয়র শিক্ষক’ হিসেবে পরবর্তী পদোন্নতি হবে। সেইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে প্রাথমিক শিক্ষকসহ বিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র মর্যাদা ও উচ্চতর বেতন কাঠামো বিবেচনা করার সুপারিশ করা হয়েছে।’

প্রচলিত কাঠামো তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেডে পদায়নের দাবি উচ্চ আদালতে সমর্থন পেয়েছে, কিন্তু সরকার এ নিয়ে রিভিউ আবেদন করেছে। সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র মর্যাদা ও উচ্চতর বেতন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কমিটির অর্ন্তবর্তী সুপারিশ হল, শিক্ষক পদে প্রবেশ দ্বাদশ গ্রেডে, দুই বছর পর স্থায়ীকরণ, আরো দুই বছর পর ১১তম গ্রেডে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি। প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে সুপারিশ হল, সরকারের রিভিউ আবেদন প্রত্যাহার ও প্রধান শিক্ষকের জন্য দশম গ্রেড নির্ধারণ এবং সকল প্রধান শিক্ষক পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ।’

সুপারিশের বিস্তারিত সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কারে গঠিত পরামর্শক কমিটি। সেখানে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ বৃদ্ধি এবং সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্য থেকে দায়িত্বভাতাসহ পদায়নের সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে সুপারিশে শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক নিয়মানুসারে উচ্চতর স্কেল পাওয়ার যোগ্য বলে মত দেওয়া হয়।

এছাড়া মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে পদোন্নতিযোগ্য পদসমূহ ও শূন্যপদ পূরণ, সমন্বিত গ্রেডেশন, পারস্পরিক বদলি, আঞ্চলিক অফিস স্থাপন এবং প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিস বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে সংস্কারের জন্য গঠিত এ পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে।

গত বছরের অক্টোবরে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কারে পরামর্শক কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটিতে একজন সদস্য সচিব এবং ৭ জন সদস্য ছিলেন।

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন অংশীগোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময় এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশের ১১টি জেলার ১২টি উপজেলায় সরেজমিনে পরিদর্শন করে সুপারিশমালা তৈরি করেছে সংস্কার কমিটি।

সেখানে থেকে পাওয়া প্রস্তাব থেকে প্রতিবেদনে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংক্রান্ত আটটি বিষয়ে শতাধিক প্রধান ও আনুসাঙ্গিক সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

পাশাপাশি এসব প্রস্তাব ও আনুসাঙ্গিক সুপারিশ বাস্তবায়নে ‘আশু, মধ্যমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে করণীয়’ চিহ্নিত করেছে কমিটি। তাদের পক্ষ থেকে পর্যালোচনায় ও সুপারিশ তৈরিতে দুটি বিষয় বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ছাড়াও আরও বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন অধ্যাপক মনজুর। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হিসেবে শিশুদের বাংলা ও গণিতের ভিত্তিমূলক দক্ষতা অর্জনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলা শুধু একটি বিষয় নয়, এটি অন্য সব বিষয়ে প্রবেশের চাবিকাঠি। গণিতে মৌলিক দক্ষতা অর্জিত না হলে শিক্ষার্থীরা শিখনে ক্রমাগত পিছিয়ে থাকবে। এ জন্য প্রতিদিন এ-দুটি বিষয়ে ৬০ থেকে ৭৫ মিনিট করে শিক্ষণ-শিখন সময় নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

‘শিখন সময় বৃদ্ধির জন্য সব বিদ্যালয়কে স্বল্প সময়ের মধ্যে এক শিফটের স্কুলে পরিণত করা প্রয়োজন। পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমে (পিইডিপিএস) অন্তত ৫০ শতাংশ বিদ্যালয়ে এবং দশ বছরের মধ্যে সকল বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু করা যেতে পারে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত অনূর্ধ্ব ১:৩০ নিশ্চিত করা দরকার।’

পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য শ্রেণির ভেতরে ও বাইরে ‘নিরাময়মূলক সহায়তা’ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, সেজন্য স্কুল স্থানীয়ভাবে প্যারা-টিচার (শিক্ষা-সহায়ক) নিয়োগ দিতে পারে।

সমাপনীর পরিবর্তে ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট
দেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের মূল্যায়নের বিষয়টিও সংস্কার প্রস্তাবে এসেছে। এ নিয়ে কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়, ধারাবাহিক ও বার্ষিক মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রত্যেক শিশুর শিখন-অগ্রগতি যাচাই করতে হবে।

কমিটির সুপারিশ, প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বা এ ধরনের পরীক্ষার পরিবর্তে ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্টে’র (এনএসএ) আদলে মৌলিক দক্ষতা জরিপের মাধ্যমে (তবে সহজে বাস্তবায়নযোগ্য) প্রতিটি বিদ্যালয়কে মান অনুযায়ী সবুজ, হলুদ, লাল রঙে চিহ্নিত করা হবে। সেক্ষেত্রে বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হবে প্রতি বিদ্যালয়কে সবুজে রূপান্তরিত করা।

দরিদ্র পরিবারের ব্যয় লাঘবের সুপারিশ
দেশের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে দরিদ্র পরিবারের ব্যয় লাঘবে নানা সুপারিশ তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এর মধ্যে দ্রুত সময়ের মধ্যে মিড-ডে-মিল প্রবর্তন, খাতা-কলম-ব্যাগ ইত্যাদি সামগ্রী বিতরণ এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত অতি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য বর্ধিত হারে অর্থ সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।

প্রাথমিকের কাঠামোগত সংস্কারে জোর দেওয়া হয়েছে ‘প্রতিরোধ এবং প্রতিকারমূলক’ বিষয়েও। সেজন্য সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি, অসদাচরণ ও কর্তব্যে অবহেলা নিয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য দেশব্যাপী হটলাইন চালু এবং সব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা, সেসব তথ্য নিয়মিত জনসম্মুখে প্রকাশের সুপারিশ করেছে কমিটি।

এছাড়া শিক্ষা শাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্যে দেশের দশ জেলার ২০টি উপজেলায় পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় পাইলট প্রকল্প শুরুর সুপারিশ করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক মনজুর বলেন, ‘চলমান ৫ বছর বা তার বেশি বয়সের শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার যথাযথ মানোন্নয়ন এবং ৪ বা তার বেশি বয়সী শিশুদের পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য বিদ্যালয়েও অভিভাবকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিস্তার প্রয়োজন।’

ঝরে পড়া ঠেকাতে ‘বিশেষ সুপারিশ’
বিদ্যালয়-বহির্ভূত ও ঝরে পড়া শিশুদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর নেতৃত্বে ‘প্রতিষ্ঠিত ও দক্ষ’ এনজিওদের সহযোগিতায় কার্যকর মডেল তৈরির বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে পরামর্শক কমিটির সুপারিশে । সেখানে সুযোগবঞ্চিতদের জন্য ‘বিশেষ উদ্যোগের’ কথা বলা হয়েছে।

এর মধ্যে বিভিন্নভাবে সুযোগবঞ্চিত শ্রমজীবী, প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগের এবং জেন্ডার ন্যায্যতা ও জলবায়ু অভিঘাত বিষয়ে ও দুর্গম এলাকার শিশু ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধিতে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে বলেছে কমিটি।

শিক্ষা কমিশন গঠন
বিদ্যালয়ে শিক্ষার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশের পাশাপাশি কমিটির পক্ষ থেকে সর্বজনীন প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মানসম্মত বিদ্যালয় শিক্ষার খাত পরিকল্পনা এবং স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের বিষয় সুপারিশ করা হয়েছে।

দেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষকদের ‘প্রি-সার্ভিস শিক্ষা’ ও যোগ্যতা অর্জন এবং শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নিরন্তর পেশাগত উন্নয়নের বিষয়েও সুপারিশ রেখেছে কমিটি।

শিক্ষা পরামর্শক পরিষদ
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে কমিটির সুপারিশে। সমগ্র শিক্ষা খাতের সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি ‘শিক্ষা পরামর্শক পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা পরে এটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশনে রূপান্তরিত হতে পারে বলে কমিটি মনে করে।

কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষা সংস্কারের জন্য কোনো সহজ জাদু-সমাধান নেই। প্রদত্ত সুপারিশ সম্পর্কে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সময়াবদ্ধ সমন্বিত বাস্তবায়ন কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রম ও সরকারের বার্ষিক বাজেট হবে সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রধান বাহন।’