বান্দরবানের একই পরিবার থেকে দুই নারী বিচারক

বান্দরবানের একই পরিবার থেকে দুই নারী বিচারক

ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী। বই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। মানে প্রিয় বন্ধুর তালিকায় ওই বই—ই ছিল খুব কাছের। আর তাই তো মেধা-মননে উজ্জ্বল মেয়েটি এবার যেন এগিয়ে গেলেন আরো এক ধাপ। স্বপ্নের পথ ধরে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেন ফারজানা ইসলাম সুইটি। বান্দরবানের মেয়ে। এবার দ্বিতীয় নারী জজ হিসেবে নাম লেখালেন দেশের জন্য। সুনাম বয়ে আনলেন পুরো পরিবারের।

তবে নারী জজ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কি সহজ ছিল মেয়েটির? মোটেই না। জানালেন, তিনবার বিজেএস পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে চতুর্থবার সফল হলেন। মানে একবার না পারিলে দেখো শতবার। ফারজানা ইসলাম সুইটির ভাষায়, প্রতিকূলতাকে জয় করার স্পৃহা ছিল, অবশেষে সফল হলাম।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এতে সুপারিশপ্রাপ্তদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ফারজানা ইসলাম সুইটি। তিনি মেধা তালিকায় ৮৯তম স্থান অর্জন করেছেন।

ফারজানা ইসলামের এই সাফল্য শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি বান্দরবান জেলার বিচার বিভাগেও এক নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। তিনি এ জেলার দ্বিতীয় নারী, যিনি বিচার বিভাগে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এর আগে, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ১২তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন তার বড় বোন, আফসানা ইসলাম রুমি।

আফসানা ও ফারজানা বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়নের সন্তান। তাদের বাবা নুরুল ইসলাম, দোছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য, এবং মা সাজেদা বেগম, যিনি এক, দুই ও তিন নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য। সমাজে নারীর অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য সাজেদা বেগম ‘রত্নগর্ভা’ ও ‘শ্রেষ্ঠ জয়ীতা’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।

আফসানা, ফারজানা এবং তাদের বড় ভাই মুজাহিদুল ইসলাম— তিনজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তারা যথাক্রমে ২০তম, ২২তম ও ১৮তম ব্যাচে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে মুজাহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এবং একইসঙ্গে বান্দরবান জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আইন পেশায় যুক্ত আছেন। পরিবারের ছোট সন্তান তাওসিফুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করছেন।

তাদের বাবা নুরুল ইসলাম এই অর্জনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে এমন সন্তান দিয়েছেন, যারা ন্যায়ের পথে চলবে এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। আমি চাই তারা সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকুক।’

মা সাজেদা বেগম জানান, শৈশব থেকেই তিনি সন্তানদের কঠোর শাসনের মধ্যে রেখেছিলেন, তবে তা শুধু পড়াশোনার জন্য নয়, বরং তাদের সততা ও নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য। আমি সবসময় চেয়েছি, আমার সন্তানেরা সত্য কথা বলবে, সৎ পথে চলবে এবং কারও ক্ষতি করবে না। আল্লাহ আমার সেই আশা পূরণ করেছেন। তারা যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে এর প্রতিদান পায়।

এদিকে জজ হিসাবে চূড়ান্ত সুপারিশ হওয়ার পর তাৎক্ষণিক মন্তব্যে ফারজানা ইসলাম সুইটি বলেন, ‘প্রতিকূলতাকে জয় করার স্পৃহা ছিল। সেই একাগ্রতার জোরেই অবশেষে সফল হলাম। এটা নিঃসন্দেহে আমার জীবনের অন্যতম পাওয়া। আমি চেষ্টা করেছি। আল্লাহ তাআলা তার প্রতিদান দিয়েছেন। এর আগে আমি ১৪, ১৫ এবং ১৬ তম বিজেএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। ৩টা পরীক্ষায় আমি প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং ভাইভা দিয়েছি। কিন্তু ৩টা পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হইনি। ১৭তম বিজেএস পরীক্ষায় সবশেষ খুশির খবরটা পেলাম।’

ফারজানা ইসলাম সুইটি আরও বলেন, ‘বিচারকের আসন এমন একটা স্থান, যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে এটি ইবাদতের একটি মাধ্যম। হাদিসে আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার আরশের নিচে যেই সাত শ্রেণির ব্যক্তি ছায়া পাবেন, তার মধ্যে একজন হলো ন্যায়পরায়ণ বিচারক বা শাসক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।’