ভাষাকে বাঁচাতে অনন্য উদ্যোগ চবিতে

ভাষাকে বাঁচাতে অনন্য উদ্যোগ চবিতে

ভাষার এই মাসে নিজ ভাষা ‘রাজবংশী’কে সকলের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে এবং ভাষাকে পরিপূর্ণ মর্যাদায় গতিশীল রাখতে অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাখন চন্দ্র রায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন ফেস্টিভ্যাল ২০২৫’-এ ‘রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র’র স্টলে বৈচিত্র্যময় এই ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচায়ক নানা অনুষঙ্গ দর্শনার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রটির স্লোগান ‘ভাষা বত্তিলে জাতি বত্তে’ অর্থাৎ ভাষা বাঁচালেই জাতি বাঁচে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘জামাল নজরুল ইসলাম রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল এন্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সস’ ও ‘চিটাগং ইউনিভার্সিটি রির্সাচ এন্ড হায়্যার স্টাডি সোসাইটি’র উদ্যোগে ‘জামাল নজরুল ইসলাম- এ এফ মুজিবুর রহমান ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন ফেস্টিভ্যাল ২০২৫’ অনুষ্ঠিত হয় । যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ রেজওয়ানা হাসান।

উৎসবজুড়ে ছিল গবেষণার নানাধর্মী প্রদর্শন। কেউ শিখাচ্ছিল, কেউ শেখাচ্ছিল বা বোঝাচ্ছিল গবেষণার অলিগলি। কেউবা তুলে ধরছিলো প্রাপ্ত ফলাফল যা এনে দেবেন যুগান্তকারী পরিবর্তন। এর মধ্যে দর্শনার্থীদের নজর কেড়েছে ‘রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রের’ একটি বর্ণিল স্টল। সাজানো হয়েছিলো বাসন্তি পলাশ ফুলের লহরীতে। সাথে সেই এতিহ্যবাহী গামছা।

দর্শনার্থীদের ঘাড়ের গামছা ‘থুইয়া’ যাওয়ার অবকাশ না থাকলেও স্টলটিতে একবার ঢুঁ মেরে আসার লোভ সংবরণ দায় ছিল। স্টলে ঢুকতেই নজরে পড়েছে বাহারি কাগজ আর বাঁশের তৈরি উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের ডালা, কৃষকের মাথার ঝাপি, চাইলন (চাল বাছার বাঁশের থালা), ডালা, কুলা, শিঁকা, হাত পাখা, সাজি, মাছ ধরার খাঁচা, মাটির কলসি, দোতারা।

স্টলের উপরে ঝুলানো কাগজে লেখা রাজবংশী ভাষার বিভিন্ন শব্দাবলি। যেমন— নাউয়া , গোন্ধায়, নাখিড়ি , ভাতার, চেতন, ফোকতোই, উটকি নাপাও , ফাশার ফুশুর, নাউয়ানি, উষুম, সিপি, ছাওয়া ইত্যাদি।

বর্ণিল কালিতে লেখা আছে ভাষাটির বিভিন্ন প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা, ছড়া , বিয়ের গীত (বিয়ের গান), ছিল্লোক কেচ্ছা। দর্শনার্থী মাত্রই জানতে চাইছিলো কোন শব্দের অর্থ কি। বহু কাল ধরে চর্চিত ভাওয়াইয়া, চট্কা, বিয়ের গীত, যাত্রাপালা, জারিগান, ভান্ডিগান, ধাঁধা, প্রবাদ- প্রবচন এই ঐশ্বর্য উপভাষারই বাহক।

বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর,দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর ও কোচবিহার অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাতৃভাষা এই রাজবংশী। এছাড়াও স্টলে ছিলো গবেষণা কেন্দ্রটির বিভিন্ন গবেষণার পোস্টার প্রদর্শনী। যেখানে রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতির বাহক আদ্য-প্রান্ত লেখা আছে সবিস্তারে। এছাড়াও এ ভাষা সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষকদের মূল্যবান বইও শোভা পাচ্ছে এই স্টলটিতে।

একজন দর্শনার্থী হিসেবে চবি বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মুরাদ হোসেন বলেন, ‘যেহেতু ভাষা যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম, তাই আমাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষারও সংরক্ষণ জরুরি। এই ভাষা ও সংস্কৃতিই আমাদের স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক। এই গুরুদায়িত্ব বেছে নেওয়ার জন্য ‘রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রে’র এই অনন্য উদ্যোগকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই।’

‘রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র’র গবেষক ডক্টর মাখন চন্দ্র রায় বলেন, ‘রাজবংশী একটি প্রাচীন লোকভাষা। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে এই ভাষার ব্যবহার কমে ভাষাটি প্রায় বিপন্নতার পথে। তাই এই ভাষা চর্চাকে উদ্বুদ্ধ করতে এবং প্রত্যেকটা জাতিকে ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে সজাগ করতে আমাদের ভাষা রক্ষার এই আন্দোলন। কোনো ভাষাই যাতে অবহেলায় হারিয়ে না যায়। বহু সংস্কৃতির ও বহুভাষার মর্যাদা যাতে রক্ষা হয়।’