সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট, প্রভাব জনজীবনে

চট্টগ্রামের বাজারে গত দুই মাস ধরে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তেলের দাম বেড়েছে, যা সাধারণ জনগণের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে সরবরাহ সীমিত রেখে দাম বাড়াচ্ছে।

নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের পাশাপাশি খোলা সয়াবিন তেলেরও সংকট তৈরি হয়েছে। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা সরকারের নির্ধারিত ১৭৫ টাকার তুলনায় অনেক বেশি। একইভাবে, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে ২ লাখ ৩২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। বিশেষ করে, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে আনা চারটি বড় চালানে ৭০ হাজার টনেরও বেশি তেল এসেছে, যা টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপের মতো বড় কোম্পানিগুলো আমদানি করেছে। তবে এত বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি হওয়ার পরও বাজারে সংকট কেন? ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকরা ইচ্ছাকৃতভাবে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন, যার ফলে খুচরা ও পাইকারি বাজারে চাহিদা অনুযায়ী তেল পাওয়া যাচ্ছে না।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ১০০ লিটার তেলের চাহিদার বিপরীতে তারা পাচ্ছেন মাত্র ২০-৩০ লিটার। এতে করে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবি, এটি সরাসরি সিন্ডিকেটের ফল, যেখানে কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

এ সংকটের ফলে ভোক্তাদের ক্ষোভও বৃদ্ধি পেয়েছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকে পর্যাপ্ত তেল না পাওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন। ক্রেতারা মনে করছেন, এই সংকট সৃষ্টির পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত রয়েছে, যারা অধিক মুনাফার আশায় বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, শুধু অভিযান চালিয়ে নয়, বরং বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।

ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির ফলে তাদের জীবনযাত্রা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। বিশেষ করে আসন্ন রমজান মাসে এ ধরনের সংকট আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সয়াবিন তেলের বাজারে যে সিন্ডিকেট কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এই সংকট দীর্ঘায়িত হতে পারে। সরকারের উচিত বাজারে সঠিক সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং মিল মালিকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এহসান উল্লাহ জাহেদী বলেন, “সয়াবিন তেলের সংকট যেন রমজান মাসে আরও প্রকট না হয়, সেজন্য এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।” তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।

এমন অবস্থায় সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা, মিল মালিক ও সরবরাহকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং প্রয়োজনে ভোজ্যতেলের আমদানি প্রক্রিয়া আরও সহজ করে বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যথায়, আসন্ন রমজানে এই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে, যা জনজীবনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।