ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। আর এ ঈদের খুশির অন্যতম অনুষাঙ্গ ঈদের নতুন পোশাক। সেই পোশাকের আভিজাত্য আর সৌন্দর্য যেন আরও এক ধাপ বাড়িয়ে তোলে ঝাউতলার বিহারিপল্লীর কারচুপি ও জারদৌসি শিল্প। সময়ের পরিক্রমায় এই শিল্প শুধু নকশার কারিগরি দক্ষতাই দেখায়নি, বরং হয়ে উঠেছে একটি সমাজের সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক।
বিহারিপল্লীর ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতে থাকা বহু উর্দুভাষী মুসলিম পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে অনেক বিহারিরা বাংলাদেশে থেকে যান। তারা নিজেদের দক্ষতা আর ঐতিহ্যকে সম্বল করেই বুনে তুলেছেন কারচুপি ও জারদৌসি শিল্পের নকশা। ঝাউতলার বিহারিপল্লী হয়ে ওঠে এই শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। তাদের পূর্বপুরুষদের হাত ধরে শুরু হওয়া এই শিল্প আজও টিকে আছে নতুন প্রজন্মের কারিগরদের প্রচেষ্টায়।
বিহারিপল্লীর অলিগলিতে পা রাখলেই চোখে পড়ে ব্যস্ততা। কাঠের ফ্রেমে টানটান করে বাঁধা কাপড়ের ওপর সুঁই-সুতা, চুমকি, পুঁথি আর কুন্দনের সূক্ষ্ম ছোঁয়ায় ফুটে উঠছে অপূর্ব সব নকশা। ফুল, পাখি, লতাপাতা — প্রতিটি আঁচড়েই যেন ঐতিহ্যের গল্প বলা হচ্ছে। এখানকার কারিগরদের হাতের নিপুণতায় কাপড়ের প্রতিটি সুতো যেন নতুন প্রাণ পায়। এই কারচুপি ও জারদৌসি শিল্প যুগ যুগ ধরে এ এলাকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি বহন করে চলেছে।
কারিগর ওয়াহিদ জানান, ঈদ এলেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুগুণ। সকাল ৯টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কাজ। বিশেষ করে মেয়েদের সেলোয়ার কামিজ ও লেহেঙ্গার অর্ডারের চাপ সবচেয়ে বেশি। প্রতি থ্রিপিসের কাজের জন্য তিনি মজুরি নেন তিন হাজার টাকা, শাড়ি ১০ হাজার, আর লেহেঙ্গা ২০ হাজার। সবচেয়ে কম মজুরিতে পাঞ্জাবির কাজ করেন ৫০০ টাকায়। ডিজাইন যত জটিল, সময়ও লাগে তত বেশি। কিছু কাজ দিনে শেষ হলেও, কিছু কাজ শেষ করতে লেগে যায় সাত দিন পর্যন্ত।
কারিগরদের ব্যস্ততা এতটাই তুঙ্গে যে অনেকে রাত জেগে কাজ করতে বাধ্য হন। রফিক নামে এক কারিগর জানান, “আমরা দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করি। কখনো কখনো ভোর পর্যন্ত সেলাই চালিয়ে যেতে হয়, কারণ অর্ডার সময়মতো বুঝিয়ে দিতে হবে। আমাদের চোখ ক্লান্ত হয়ে আসে, হাত ব্যথা হয়ে যায়, কিন্তু কাজ থামানোর উপায় নেই।”
তবে ঈদের এই উন্মাদনার মাঝেও ঝাউতলার কারিগরদের কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। ওয়াহিদ জানালেন, “বিদেশি মেশিনে তৈরি পোশাকের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। আগে এখানে ২০০টির মতো কারখানা ছিল, এখন টিকে আছে মাত্র ১০-১৫টি। লাভের পরিমাণও কমে গেছে। মজুরি যেটুকু পাই, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।”
বিহারিপল্লীর আরেক কারিগর রফিক জানান, “আমাদের কাজ শুধু পোশাক বানানো নয়, প্রতিটি সুঁইয়ের ফোঁড়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে বুনে চলেছি। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”
অথচ এই শিল্পের রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্ভাবনাও। ভারত, পাকিস্তান, এমনকি বিভিন্ন আরব দেশেও বিহারিপল্লীর তৈরি বোরকা ও আবায়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ডিজাইনের গুণগত মান এবং কারচুপির সূক্ষ্মতায় এই পোশাকগুলো বিদেশি ক্রেতাদের মন কেড়েছে। কিন্তু কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকায় রপ্তানির সেই সুযোগও সঙ্কুচিত হচ্ছে।
বিহারিপল্লীর এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে কারিগররা সরকারের সহায়তা চেয়েছেন। তাদের মতে, যদি যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা পাওয়া যায়, তবে এই শিল্প আবারও প্রাণ ফিরে পাবে এবং দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও জায়গা করে নেবে। সরকারি প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণ এবং আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হলে এই শিল্প আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে বলে তারা মনে করেন।
ঈদের আলোয় মুখরিত বিহারিপল্লী, তবে কারিগরদের মনে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। তাদের প্রত্যাশা — ঐতিহ্যের এই শিল্প শুধু ঈদকেন্দ্রিক না থেকে টিকবে সারা বছর, ছড়িয়ে পড়বে বিশ্ববাজারে, আর তারা আবার গড়ে তুলবে নতুন স্বপ্নের কারখানা। প্রতিটি সুঁইয়ের ফোঁড়ে তারা আঁকবেন নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা।