বাংলাদেশের সমুদ্র পরিবহন খাতে একটি অধ্যায়ের ইতি টানলো বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস গড়ে অবশেষে নিলামের মাধ্যমে তাদের যাত্রা শেষ হলো। এই দুই জাহাজ শুধুমাত্র বাণিজ্যের বাহন ছিল না, তারা ছিল বাংলাদেশের সামুদ্রিক গৌরবের প্রতীক।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) ১৯৮৭ সালে ডেনমার্ক থেকে বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ সংগ্রহ করেছিল। তখনকার সময়ে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এই জাহাজ দুটি দেশের সমুদ্র পরিবহন খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। বাংলার জ্যোতি ৮০৫ কোটি টাকা আর বাংলার সৌরভ ৭৩১ কোটি টাকা আয়ের সাক্ষী হয়ে আছে। এই আয়ের মাধ্যমে বিএসসি নিজেদের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে এবং দেশের বাণিজ্যিক পরিবহন ব্যবস্থাকে করেছে আরও সমৃদ্ধ।
সময়ের পরিক্রমায়, দীর্ঘদিন সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন করতে করতে জাহাজ দুটি যেমন অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বহন করে, তেমনই বহন করে পরিধানের চিহ্ন। বছরের পর বছর পণ্য বহনের দায়িত্ব পালন করতে করতে বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ হয়ে উঠেছিল নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু বয়সের ভার আর প্রকৃতির ক্ষয় তাদের আর সাগরে ভাসিয়ে রাখার সুযোগ দিল না।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলার জ্যোতিতে এবং ৫ অক্টোবর বাংলার সৌরভে ঘটে অগ্নিকাণ্ডের মর্মান্তিক ঘটনা, যাতে প্রাণ হারান চারজন। এই অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের সমুদ্র পরিবহন খাতের জন্য এক দুঃখজনক অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। প্রাণহানির ক্ষত আর দুই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ বিএসসিকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
অগ্নিকাণ্ডের পর বিএসসি দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় জাহাজ দুটি আর পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী নয়। বয়সের ভার আর ক্ষতিগ্রস্ত কাঠামো তাদের আর সাগরে ভাসিয়ে রাখার উপায় রাখেনি। তাই এগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয় ৫ ডিসেম্বর। বিএসসি এই দরপত্রের মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক দিক নয়, বরং পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ উপায়ে জাহাজ পুনর্ব্যবহারের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে চেয়েছে।
৭ জানুয়ারি দরপত্র খোলা হলে ১৬টি দরপত্র জমা পড়ে। প্রথম সর্বোচ্চ দরদাতা মাস্টার অ্যান্ড ব্রাদার্স ৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা প্রস্তাব করলেও করসহ ৪৫ কোটি ৮৬ লাখ ৬১ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিরি সুবেদার শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ পেয়েছে জাহাজ দুটির মালিকানা। সংরক্ষিত মূল্য ছিল ৩৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।
২৭ ফেব্রুয়ারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর, ৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে জাহাজ দুটি জিরি সুবেদার শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং বিচিং সম্পন্ন হয়। বিচিংয়ের মাধ্যমে জাহাজ দুটির যান্ত্রিক জীবন শেষ হলেও, তাদের স্মৃতি থেকে যাবে দেশের সমুদ্র পরিবহন খাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে।
বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সাধারণত এই ধরনের জাহাজ ২৫-২৬ বছরের বেশি চালানো যায় না। তবুও দক্ষ মেইনটেন্যান্সের মাধ্যমে এগুলো আরও কয়েক বছর চলেছে। তবে এখন আর এগুলো পুনরায় ব্যবহারের সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, বিএসসি সরকারের একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং এই জাহাজ বিক্রির মধ্য দিয়ে আমরা ভবিষ্যতে নতুন ও আধুনিক জাহাজ সংযোজনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি।
বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ শুধু দুটি জাহাজ নয়, বাংলাদেশের সমুদ্র পরিবহন খাতের একটি প্রতীক। তাদের বিদায় যেন এক যুগের সমাপ্তি। এই জাহাজগুলোর মাধ্যমে আমরা অতীতের গৌরবকে স্মরণ করি, আবার নতুন দিনের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকি। বিএসসি তাদের বহরে যুক্ত করবে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন জাহাজ, যা দেশের সমুদ্র বাণিজ্যকে আরও গতিশীল করে তুলবে।
বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভের বিদায় তাই শুধুমাত্র একটি লেনদেনের ঘটনা নয়, বরং এটি এক ইতিহাসের সমাপ্তি এবং ভবিষ্যতের সমুদ্র পরিবহনের নতুন দিনের সূচনা।